Blog

ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশনের পদ্ধতি ও খরচ

এই যে, আপনারা স্ক্রিনে দুইটা লোগো দেখতে পাচ্ছেন এবং একটু ভালো করে খেয়াল করুন ম্যকডোনাল্ডস্‌ এর লোগোর পাশে ছোট্ট করে (R) লেখা আছে আবার এইযে স্ট্রার বাকস্‌ এর লোগোর পাশে ছোট্টো করে (TM) কথাটি লেখা আছে। আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটা কেন লেখা হয়েছে, এটার অর্থ কি?

এটা হল ট্রেড মার্ক। হ্যা বন্ধুরা এতক্ষনে আপনারা নিশ্চয় বুঝে গিয়েছেন আজকের আর্টিকেলে আমরা ট্রেড মার্ক কি, কেন করা হয়, এর সুবিধা, এ সংক্রান্ত বাংলাদেশি আইন-কানুন এবং ট্রেড মার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ট্রেড মার্ক বলতে- কোন ইউনিক নাম, লোগো, সিম্বল, ফ্রেইজ, স্লোগান, ট্যাগলাইন,শেপ,ডিজাইন অথবা এগুলোর কম্বিনেশন কে বোঝায় যার দ্বারা কোন ব্যান্ড,পন্য বা সেবা কে চিহ্নিত করা যায়।

 

কেন ট্রেড মার্ক ব্যবহার করবেনঃ

মনে করুন বা কল্পনা করুন- ডেটল বাংলাদেশ লিমিটেড নামে আপনি একটি কোম্পানি খুললেন এবং আপনি সাবান প্রস্তুত করে বাজারজাত করা শুরু করলেন। কয়েক বছর ধরে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে, আপনার মেধা, শ্রম দিয়ে, গবেষণা করে নতুনত্ব এনে, বিজ্ঞাপন দিয়ে, মার্কেটিং করে, নানা ধরনের ক্যামপেইং করে, আজ আপনার ব্যান্ডের একটা ভ্যালু ক্রিয়েট হয়েছে এবং বাজারে আপনার সাবানের প্রচুর সেল হচ্ছে। এমতাবস্থায় হঠাৎ আপনি দেখলেন একই নামে, একই ডিজাইনে, একই মোড়কে অন্য কেউ বাজারে সাবান সরবরহ করছে। সে সাবানের কোয়ালিটি ভালো না। এতে করে আপনার ব্যবসায়ে লোকসান হচ্ছে, আপনার ব্যান্ডের সুনাম যা আপনি এত বছর ধরে একটু একটূ করে তৈরি করেছিলেন তা নষ্ট হচ্ছে। খোজ নিয়ে দেখা গেল কোন অসাধু ব্যবসায়ী অতি লাভের আশায় এমন প্রতাড়নামূলক কাজ করছে।


আমরা ক্রেতা হিসাবেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রায়শই কিন্তু এমন সমস্যার সম্মূখীন হয়ে থাকি। যেমন আপনি এডিডাস এর লোগো থেকে একটা জুতা অনেক দাম দিয়ে কিনলেন, পরে দেখলেন যে, নাম-লোগো ঠিক থাকলেও এটা এডিডাস না, এটা চায়না কপি। আবার Bata লেখা দেখে বাটার জুতা কিনলেন, কিন্তু বাসায় এসে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন যে এটা আসলে Bala লেখা।

প্রনিনিয়তই এভাবে ক্রেতারা প্রতাড়িত হয়ে থাকে, এবং অরিজিনাল ব্যান্ড মুনাফা ও সুনাম হারায়।

তো এক্ষেত্রে আপনার ব্যান্ড, পন্য বা সেবার ট্রেড-মার্ক টি যদি রেজিস্ট্রেশন করা থাকে, তাহলে আপনি ঐ সমস্ত অসাধু ব্যবসায়ি এবং জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন, তাদের শাস্তি দাবি করতে পারেন, ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।

ট্রেড মার্ক চিহ্ন বোঝার উপায়ঃ


যদি কোন নাম, লোগো বা ডিজাইনের পাশে ® লেখা থাকে তাহলে বুঝতে হবে এটি যথাযত সরকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবন্ধিত বা রেজিস্ট্রার্ড ট্রেড মার্ক। কেউ চাইলেই তার লোগো বা ব্যান্ডনেমের পাশে ® লিখে রাখতে পারেবা। অ-নিবন্ধিত ট্রেডমার্কে ® প্রতীক ব্যবহার করা একটি ফৌজদারি অপরাধ, এক্ষেত্রে রাষ্ট্র su-moto মামলা করতে পারে।

TM বা ট্রেডমার্ক হল অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের চিহ্ন। এটি কোন পণ্য বা ব্র্যান্ডকে মানুষের সাথে পরিচিত করানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন, ™

Product এর ক্ষেত্রে যেমন TM ব্যবহার করা হয়, কোন সেবার ক্ষেত্রে SM বা সার্ভিস মার্ক ব্যবহার করা হয়, যেমন- কোন হোটেল, হসপিটাল বা ট্রান্সপোর্টেশন সার্ভিসের ক্ষেত্রে।

ট্রেড মার্ক সংক্রান্ত রেগুলেটরি বডিঃ

ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯ এবং ট্রেডমার্ক বিধি, ১৯৬৩ অনুসারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন- পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন দিয়ে থাকে।

ট্রেড-মার্ক নিবন্ধনের সুবিধা:

যেকোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান,  শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তার পণ্য বা সেবা ট্রেডমার্ক (™) বা সার্ভিসমার্ক (SM) রেজিষ্ট্রেশন এর মাধ্যমে আইনগত সুবিধা পায়। ফলে অন্য কেউ তাদের মার্ক নকল করে অনৈতিক ভাবে সুবিধা পাবেন না। এতে সাধারণ ক্রেতা বা ভোক্তা ও প্রতারিত হবেন না।

অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের অসুবিধা:

ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করা না হলে আদালতে ট্রেডমার্ক লংঘনের প্রতিকার পাওয়া যাবে না।

ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করা না হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়িক সুনাম ব্যহত হয়।

ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করা না হলে মালিক তার নিরংকুশ ব্যবহারের অধিকার লাভ করতে পারে না।

অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের স্বত্ত্বধিকারীরাও ট্রেডমার্ক লংঘনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। অনিবন্ধিত স্বত্বাধিকারীরা সাধারণত নিবন্ধিত স্বত্বাধিকারীদের চেয়ে কম আইনি সহায়তা পেয়ে থাকেন।

আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:

  • মার্ক/লোগো বা নাম যা আপনি ট্রেড মার্ক হিসাবে নিবন্ধন করতে চাচ্ছেন তা টেকসই কাগজে প্রিন্ট করে আঠা দিয়ে আবেদন ফর্মের সাথে যুক্ত করতে হবে। আপনার মার্ক বা লোগোর বর্ননা লিখতে হবে।
  • আবেদনকারীর নাম
  • আবেদনকারীর ঠিকানা ও জাতীয়তা
  • আবেদনকারীর পদমর্যাদা। যেমন- মালিক বা প্রোপাইটর, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, কোম্পানি হলে কোম্পানির নাম ও তথ্যাবলি।
  • মালামাল/সেবার সবিস্তার বিবরণী ও ধরণ
  • মার্ক ব্যবহারের তারিখ (তা বাংলাদেশে ব্যবহৃত হোক কিংবা ব্যবহারের জন্য প্রস্তাবিত হোক)
  • আইনজিবি বা এজেন্টকে দেওয়া যথাযত স্ট্যাম্পে প্রিন্ট কৃত পাওয়ার অফ এ্যাটোর্নি বা আম-মোক্তার নামার কপি।

ট্রেড মার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াঃ

১। ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করার আগে দেখতে হবে যে ঐ ট্রেডমার্কটি ইতিপূর্বেই ব্যবহৃত কিংবা অন্য কারো দ্বারা রেজিস্টার্ড হয়েছে কি না। এটার জন্য মেনুয়ালী আপনাকে DPDT (Department of Patents, Designs and Trademarks) এর অফিসে গিয়ে আবেদন করে জানতে হবে। এখনোও পর্যন্ত এটা অনলাইনে দেখার কোন ব্যবস্থা নেই।

২। আপনার কাঙ্খিত ট্রেড মার্কটি ফ্রি থাকলে, DPDT এর অফিস থেকে আবেদন করার জন্য রেজিস্ট্রেশন ফরম TM-01, সংগ্রহ করে এবং সঠিকভাবে পূরণ করে জমা দিতে হবে। আবেদন ফিস ৩৫০০ টাকা এর কিছু কম বেশি হতে পারে প্লাস ১৫% ভ্যাট।

৩। আবেদনের তথ্য এবং আবেদন-কৃত ট্রেড মার্কটির  ট্রেড মার্ক আইনের কোন প্রভিশনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কিনা বা পূর্বে নিবন্ধিত কোন ট্রেড-মার্কের সাথে মিল আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় ট্রেড মার্ক পরীক্ষক কর্তৃক পরিক্ষা করিয়া যদি কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত না হয় তাহলে আবেদনকারীর মার্কটি ট্রেডমার্ক জার্নালে প্রকাশের জন্য অনুমতি লাভ করবে।

জার্নালে প্রকাশের জন্য ফিস ১ হাজার টাকা এবং ১৫% ভ্যাট।

৪। জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী ২ মাসের মধ্যে যদি ট্রেড মার্কটির ব্যাপারে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কেউ আপত্তি না জানায়, তাহলে ট্রেড মার্কটি নিবন্ধনের জন্য গৃহিত হবে মর্মে একটি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।

৫। এর পর রেজিস্টেশন ফিস- ১৫,০০০ ৳ (এই এমাউন্ট কিছু কম বেশি হতে পারে) + ১৫% ভ্যাট, প্রদান করতে হবে। ফিস জমাদেওয়ার পর আবেদনকারিকে নিবন্ধন সনদ প্রদান করা হয়। ট্রেড মার্ক রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ ৭ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে, এর পর প্রতি ১০ বছর পর পর রেজিষ্ট্রেশন নবায়ন করা যায় অনিদৃষ্টকাল পর্যন্ত। আবেদন কারীর মৃত্যুর পর চাইলে তার উত্তরাধিকারিরাও একই ভাবে নবায়ন করে যেতে পারে।

ট্রেডমার্ক লংঘনের প্রতিকার:

বাংলাদেশে প্রচলিত ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯ এবং penal code, 1860 অধীনে ট্রেডমার্ক ইনফ্রিঞ্জমেন্ট এর দায়ে civil and criminal remedy ’র ব্যবস্থা রয়েছে।

ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯ এর ৯৬ ধারার অধীনে কোন নিবন্ধিত ট্রেডমার্কের লঙ্ঘন করা হলে, নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক সংশ্লিষ্ট কোন অধিকার এবং সাদৃশ্যপূর্ণ বা প্রতারণামূলকভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ কোন ট্রেডমার্ক সেটা নিবন্ধিত হোক বা না হোক  ব্যবহার করা জেলা জজ আদালতে মামলা দায়ের করা যায়।

দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৪৮৬ ও ৪৮৭ ধারা এবং ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯-এর ৭৪ ধারা অনুসারে false মার্ক বা বর্ণনা যুক্ত পণ্য বিক্রি করা, এক ধরনের পণ্যের মোড়কে অন্য ধরনের পণ্য প্যাকেট করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ট্রেডমার্ক আইনে প্রথমবার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ২ বছর এবং সর্বনিম্ন ৬ মাসের কারাদণ্ড সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে আবার দণ্ডবিধিতে ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

ট্রেড মার্ককে ইন্টিলেকচুয়াল প্রোপার্টি হিসাবে গন্য করা হয়। যে কারনে দেশের বাইরেও এটা বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল ট্রিটি এবং কনভেনশনের মাধ্যমে রক্ষিত হয়।

ট্রেডমার্ক আইনের ৮৬ ধারার বিধান অনুসারে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ৩ বছর অথবা বাদী কর্তৃক তথ্য উদঘাটিত হইবার অনধিক দুই বছরের মধ্যে (যা আগে ঘটে) সেই সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হয়।