২০১৭ সালে একটি কাজে ই-টিআইএন নিয়েছেন সাইফুজ্জামান সুমন। চাকরিজীবী সুমন কখনও আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এই চাকরিজীবীর রিটার্ন দাখিলের ব্যর্থতায় জরিমানা হওয়ার কথা। ব্যাংক হিসাব খুলতে ২০১৪ সালে ই-টিআইএন নিয়েছেন উদ্যোক্তা রোকেয়া বেগম। করযোগ্য আয় নেই বলে অদ্যাবধি তিনি রিটার্ন দাখিল করেননি। যদিও করযোগ্য আয় না থাকলেও প্রতি বছর তার রিটার্ন দেয়ার বিধান রয়েছে; না দিলে জরিমানার বিধান রয়েছে।
শুধু চাকরিজীবী সুমন আর উদ্যোক্তা রোকেয়া নন এমন প্রায় ৫০ লাখ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দাখিল করেন না। ফলে প্রতি বছর রিটার্ন দাখিল ও কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। তবে ই-টিআইএন নেয়ার পর যারা কোনোদিন রিটার্ন দাখিল করেননি এমন করদাতাদের জন্য প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ বাজেটে ছাড় বা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন করদাতাদের জরিমানা ছাড়াই রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। শুধু তা-ই নয়, এসব করদাতা ‘কর দিবস (৩০ নভেম্বর)’-এর মধ্যে নয়, সারাবছর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। সেজন্য বাজেটে কর দিবসের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, করনেট সম্প্রসারণ ও নতুন করদাতাদের সুযোগ দিতেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। করদাতারা এই সুযোগ নিলে একদিকে করদাতা বাড়বে, অন্যদিকে রিটার্ন দাখিল বাড়বে। তাছাড়া প্রায় ৪০টি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ই-টিআইএন সনদ বাধ্যতামূলক ছিল। এবার করদাতাদের সেই সেবা গ্রহণ করতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দিতে হবে। ফলে রিটার্ন দাখিল ও করদাতা বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে করযোগ্য প্রায় এক কোটি মানুষ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র এক শতাংশ কর দেন। গত ৩১ মে পর্যন্ত ই-টিআইএন নিবন্ধন নিয়েছেন প্রায় ৭৮ লাখ। এর মধ্যে রিটার্ন দাখিল হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৫ লাখ (প্রায় ২৫ লাখ ব্যক্তি ও ২০ হাজার কোম্পানি)। আর ২০২০-২১ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ।
আয়কর বিভাগের হিসাবমতে, প্রতিটি কর অঞ্চল থেকে ই-টিআইএনধারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে রিটার্ন দাখিল করতে নোটিস দেয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ই-টিআইএন-এ দেয়া ঠিকানায় সেই ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার খুঁজে পাওয়া গেলেও তারা রিটার্ন দেয় না। একাধিক নোটিস দেয়া হলেও কর্ণপাত করে না। গত দুই বছর কর অঞ্চল থেকে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ই-টিআইএন-এ দেয়া মোবাইল ফোন নম্বরে খুদেবার্তা দিয়ে রিটার্ন জমা দেয়ার জন্য তাগিদ দেয়া হয়। এরপরও বেশিরভাগ টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না। যদিও ২০১৯ সাল থেকেই প্রত্যেক টিআইএনধারীর জন্য রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।
কর কর্মকর্তারা বলছেন, রিটার্ন জমায় ব্যর্থতার আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় রিটার্ন দাখিল বাড়ছে না। যদিও রিটার্ন দাখিল ব্যর্থতায় জরিমানার বিধান রয়েছে, তবে জরিমানার চেয়ে করদাতাদের মধ্যে রিটার্ন দাখিলে সচেতনতা তৈরি করতে চায় এনবিআর। সেজন্য রিটার্ন দাখিল বাড়াতে ই-টিআইএনধারীদের জন্য বাজেটে বড় সুখবর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
করনেট সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘নতুন করদাতাদের রিটার্ন দাখিল ও কর প্রদানে আগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ট্যাক্স ডে -এর সংজ্ঞায় পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে যে সব করদাতা আগে কখনোই রিটার্ন দাখিল করেননি, তাদের জন্য আয়বর্ষ-পরবর্তী সম্পূর্ণ করবর্ষব্যাপী বিনা জরিমানায় আয়কর রিটার্ন দাখিলের বিধান প্রস্তাব করছি।’
অন্যদিকে করনেট সম্প্রসারণে বাজেটে আরও কয়েকটি প্রস্তাব দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছেÑটিআইএন সনদের পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিলে ব্যর্থ হলে ঠিকাদার বা সরবরাহকারীর কাছ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি হারে উৎসে কর কর্তনের বিধান করা; ব্যাংক সুদ আয় হতে উৎসে কর কর্তনের বিধানে টিআইএন সনদের পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ ব্যাংকে দাখিলের বিধান করা; এক কোটি টাকার ঊর্ধ্বে টার্নওভার রয়েছে এমন হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, রিসোর্ট ও ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিকে উৎসে কর কর্তনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে গণ্য করার বিধান করা; উৎসে কর সংগ্রহের আওতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ নৌযান ও বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে এসআরও অনুযায়ী প্রদত্ত করহার ঠিক রেখে ন্যূনতম করের আওতায় উৎসে কর সংগ্রহের বিধান করা; টিআইএনধারীর পরিবর্তে যেসব করদাতাকে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে, এমন সব করদাতার রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থতায় আয়কর অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘কোনো করদাতা আয়কর অধ্যাদেশের ৭৫ ধারানুসারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হলে, তার ওপর আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪ ধারা অনুযায়ী জরিমানা, ৭৩ ধারা অনুযায়ী ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত সরল সুদ এবং ৭৩এ ধারা অনুযায়ী বিলম্ব সুদ আরোপযোগ্য হবে। যে ক্ষেত্রে করদাতা রিটার্ন দাখিলের জন্য সময়ের আবেদন করে উপকর কমিশনার কর্তৃক মঞ্জুরকৃত বর্ধিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করবেন, সে ক্ষেত্রে করদাতার ওপর জরিমানা আরোপিত হবে না, তবে অতিরিক্ত সরল সুদ ও বিলম্ব সুদ আরোপিত হবে।’
এ বিষয়ে আয়কর বিভাগের এক সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একজন ব্যক্তি রিটার্ন জমা না দিয়ে নিজের জন্য বড় ধরনের ঝামেলার পথ তৈরি করছেন। যদি কোনো ব্যক্তি সময়মতো আয়কর রিটার্ন দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাকে আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী এক হাজার টাকা অথবা আগের বছরের ট্যাক্সের ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। এ দুটির ভেতরে যেটি পরিমাণে বেশি, সেই অঙ্কটি পেনাল্টি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে যদি কেউ রিটার্ন দাখিল না করেন, তাহলে ওই জরিমানা ছাড়াও যত দিন ধরে তিনি রিটার্ন দেননি ওই পুরো সময়ের দিনপ্রতি ৫০ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে। তবে তা যত দিনই হোক না কেন নতুন করদাতা হলে সব মিলিয়ে জরিমানার পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকার ওপরে নেয়া হবে না। আর পুরোনো করদাতা হলে আগের বছর যে পরিমাণ অর্থ আয়কর হয়েছে, সেটিসহ ওই অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দিতে হতে পারে।’
পোস্ট কার্টেসিঃ শেয়ারবিজ